বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩১ পূর্বাহ্ন
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:
আরব জাতীয়তাবাদ বলে একটি জিনিস ছিল এক সময়ে। এই জাতীয়তাবাদের একটি সর্বজনীন রণধ্বনি ছিল, ‘জবরদখলকারী ইসরায়েলের হাত থেকে অধিকৃত প্যালেস্টাইনকে উদ্ধার করো।’ সেটা ছিল সবদিক দিয়েই ন্যায়সংগত দাবি। এ নিয়ে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদের আগ্রাসন যতই শক্তিশালী হয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণ ততই কোণঠাসা ও স্বজনহীন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের আগ্রাসন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। আরব জাতীয়তাবাদ এখন আরব লিগের দাপ্তরিক কাগজপত্রে এসে ঠেকেছে। ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখলে উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোষণা দিয়েছিল দখল-করা ভূমি ইসরায়েলকে অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। ২০০২ সালে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ (ওআইসি) ‘আরব শান্তি’ স্থাপনের উদ্দেশে বলেছিল যে, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের যে ভূখ- দখল করে নিয়েছে তা ফিরিয়ে না দিলে ইসরায়েলের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হবে না। এই উদ্যোগের প্রধান ভূমিকা ছিল সৌদি আরবের। কিন্তু ওই অবস্থানে আরব দেশগুলো অনড় থাকেনি। আরব জাতীয়তাবাদ ভেঙে পড়েছে, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। যার অর্থ রাষ্ট্রশাসকদের স্বার্থ। ১৯৭৯ সালে মিসর এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করে। এবার একই কাজ করল সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন।
আরবদের ঐক্য ভাঙতে মধ্যস্থতা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এখন হট্টগোল করছেন যে এটি তাদের বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। অনুগত গণমাধ্যম আওয়াজ দিচ্ছে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তা বটে। ফিলিস্তিনিদের আরও বেশি কোণঠাসা করার এবং তাদের ভূমি দখলে ইসরায়েলি জাতীয়তাবাদীদের অধিকতর আগ্রাসী হওয়ার জন্য সুযোগ বাড়ল বৈকি। দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের পাশাপাশি আপসমূলক অস্তিত্বের যে সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছিল সেটা বড় একটা ধাক্কা খেল অবশ্যই। অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে এমন আশঙ্কা খুবই বাস্তবসম্মত। সৌদি আরব বলেছে তারা এখনই প্রস্তুত নয়। তবে ঘটনার পেছনে যে সৌদি কলকাঠি নাড়া আছে সেটা তো সবারই জানা। আরব দেশের ধনী ব্যক্তিরা বিধর্মী ধনকুবের ট্রাম্পকে অনেক ভালো বন্ধু মনে করে, দরিদ্র মুসলিম ফিলিস্তিনি নিকটাত্মীয়দের তুলনায়। গরিবের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে কে কবে লাভবান হয়েছে? সৌদি আরব নিশ্চয়ই ফুসলাবে অন্য আরব এবং অ-আরব মুসলিম দেশগুলোকেও। বাংলাদেশকেও নিতে চাইবে সঙ্গে। তেমন তৎপরতা যে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যায়নি এমনও নয়। সৌদি আরব চায় আরব অঞ্চলে তার প্রাধান্য অক্ষুণœ রাখতে। তার জন্য মার্কিন সাহায্য দরকার; ইসরায়েলের সমর্থনও প্রয়োজন। বিশেষ করে সৌদি আরবের একমাত্র বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে পরাভূত করার জন্য। ইরানের ব্যাপারে শিয়া-সুন্নি বিরোধ জাগিয়ে তোলাটা যথেষ্ট নয়, শক্তিধর রাষ্ট্রের সহযোগিতা আবশ্যক; সে রাষ্ট্র খ্রিস্টান হোক কি ইহুদি হোক তাতে কিছু যায় আসে না। ফিলিস্তিনিরা নিজেরাও বিভক্ত হয়ে আছে; এবার শোনা যাচ্ছে তারা ঐক্যবদ্ধ হবে। হামাস ও ফাতাহ’র বিরোধ নাকি থাকবে না। মূল ভরসা অবশ্য ফিলিস্তিনিদের ঐক্যই।
আর ভরসা বিশ্বজনমত। বিশ্বজনমত অর্থ মোটেই রাষ্ট্রশাসকদের মত নয়। সেটা পাওয়া যাবে না। আরব বিশ্ব যে এখন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, প্রয়োজনে তাদের বুকে লাথি মারতেও সে যে দ্বিধা করবে না, তার কারণ রাষ্ট্রশাসকরা নিজেদের স্বার্থটাই শুধু দেখে, জনগণের স্বার্থ তো দেখেই না, দেখা প্রয়োজনও মনে করে না। আরব জনগণ নিশ্চয়ই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আছে। কিন্তু আরব বিশ্বে রাষ্ট্রশাসকরা এমনই স্বৈরাচারী, জনগণের কণ্ঠরোধ করতে এরা এতটাই দক্ষ যে জনগণের পক্ষে মুখ খুলবার উপায়টি নেই। আবার জনগণের লড়াইটা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনিরাও ওই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই লড়ছে। এরা নতুন এক আন্তর্জাতিকতা গড়ে তুলবে এটাই আশা। এই আন্তর্জাতিকতা অবশ্যই বিশ্বায়নের নয়। বিশ্বায়ন হচ্ছে বাণিজ্যিক; পুঁজিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিকতা হবে মনুষ্যতান্ত্রিক। করোনাভাইরাস তা-বের ভেতর অল্পস্বল্প ইতিবাচক দিক যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা হলো পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী নির্মমতার উন্মোচন এবং তার বিপরীতে পুঁজিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিকতার আবশ্যকতাকে জোরদার করা।
ইসরায়েলের পক্ষে নতুন মিত্রদের একসঙ্গে পেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আহ্লাদে আটখানা হয়েছেন। তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এবং হোয়াইট হাউজের চত্বরেই তো তিনপক্ষের চুক্তি সই হয়েছে। কয়েকশ’ অতিথিকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, করোনায় নিষেধ সত্ত্বেও সাতশ’ অতিথি নাকি হাজির হয়েছিলেন ওই উৎসবে। এলাহি কা-! ট্রাম্প আশা করছিলেন নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। তা তিনি তো অনেক কিছুই করছেন। তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার আয়োজনও চলছিল। বিশ্বশান্তির পক্ষে তার সর্বপ্রধান অবদান তো ফিলিস্তিনিদের সর্বনাশ ঘটানোর জন্য তার তৎপরতা। তা কিছুটা সুবিধা তিনি আশা করতে পারেন বৈকি। কারণ উগ্রজাতীয়তাবাদীরা খুশি হবে। তারা ভাববে ভালোই হয়েছে, মুসলমানদের এক ঘা দেওয়া গেছে। বিশেষ ভাবে খুশি হবে ইহুদি লবি; যারা বিত্তবান, যারা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারঙ্গম। কিন্তু নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের জো বাইডেনের জয়ও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা সুখবর নয়। তিনিও ইসরায়েলেরই সমর্থক। তার ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন প্রাপ্তির পেছনে ইহুদি লবির সমর্থন আছে, যেমন সমর্থন আছে ওয়ালস্ট্রিটের পুঁজিপতিদেরও। এদের কারণেই জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বার্নি স্যান্ডার্স মনোনয়ন পেলেন না। একবার নয়, দু’বারই ব্যর্থ হলেন। এবার মনোনয়ন পেলেন জো বাইডেন, আগের বার যেমন পেয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। হিলারি ক্লিনটন তো ঘোষণা দিয়েই ইরানের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বারাক ওবামাও তার আগের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের পররাষ্ট্রনীতিরই সমর্থক ছিলেন। জর্জ বুশ মধ্যপ্রাচ্যকে ছারখার করে দিয়েছেন, ওবামা সেই নীতি থেকে এক পা সরে আসেননি।
ট্রাম্প অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্তরের লোক। তার মতো স্থূল ও নীতিনৈতিকতাহীন একজন প্রেসিডেন্টকে আমেরিকার জনগণের পক্ষে এর আগে কখনোই সহ্য করতে হয় নি। তার দ্বিতীয় স্ত্রী যখন সন্তানের জন্ম দিচ্ছিলেন সেই সময়ে তিনি ব্যস্ত ছিলেন এক প্রমোদবালার সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতায়। এ পর্যন্ত এক ডজন নারী তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। তার নিজের পরিবারের লোকেরাই মুখে নয়, বই লিখে বলেছেন যে, তিনি মিথ্যুক ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। জলবায়ু পরিবর্তনের যে সমস্যা আছে সেটা তিনি মানেন না, বিজ্ঞানীদের উড়িয়ে দিতে চান তুড়ি মেরে। তার কাছের লোকেরা কেউ কেউ তার পাশে থাকা আর সম্ভব নয় দেখে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন।
উদারনীতিকদের মধ্যে যারা বেশি পরিমাণে উদারনীতিক তারা জো বাইডেনে কোনো অসুবিধা দেখেন না। কারণ উদারনীতি আর যাই চাক পুঁজিবাদের অবসান চায় না। স্বল্পসংখ্যক উদারনীতিক দেখতে পাচ্ছেন যে জো বাইডেনের কাছ থেকে নেতিবাচক কিছু পাওয়া গেলেও ইতিবাচক জিনিস পাওয়ার আশাটা কম। কিন্তু তাই বলে তারা তো আর বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থক নন।
ওসামা বিন লাদেনের এক ভ্রাতুষ্পুত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে নির্বাচনে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন দেবেন। অবিশ্বাস্য? কৌতুককর? কৌতুককর ঠিকই, কিন্তু অবিশ্বাস্য মোটেই নয়। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বিন লাদেনের ভেতর পার্থক্য অবশ্যই আছে; মস্ত মস্ত ব্যবধান দৃশ্যমান। নামে, পোশাকে, চেহারায়, ভাষায়, ধর্মমতে তারা পরস্পর থেকে যতটা দূরে থাকা সম্ভব ঠিক ততটাই দূরের। কিন্তু মতাদর্শের দিক থেকে তারা নিকটাত্মীয়। উভয়েই পুঁজিবাদী, এবং প্রতিযোগিতামূলক ভাবেই সমাজতন্ত্রবিরোধী। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ারে যে বিমান হামলা করা হয়, গুনে দেখা গেছে যে তাতে ২,৯৭৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে। কাজটা লাদেনের লোকেরাই করেছে বলে সন্দেহ। এতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সুবিধা হয়েছে ‘মানবসভ্যতা রক্ষা’ করার স্ব-আরোপিত দায়িত্ববহনকারী হিসেবে তারা লাদেনের ঘাঁটি আফগানিস্তানে ও পরে ইরাক ও লিবিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার মওকা পেয়ে গেছে। দু’পক্ষ যে একত্রে বসে ছক কেটে শলাপরামর্শ করে কাজটা করেছে তা নয়। লাদেনের কথিত লোকেরা আমেরিকার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বুশদের ক্রুসেডকে সুযোগ করে দিয়েছে নিরীহ মানুষ হত্যা করবার। শরিকদের মধ্যে লড়াই। তবে দু’পক্ষই সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার পবিত্রতা রক্ষার পক্ষে অঙ্গীকারবদ্ধ সৈনিক, এবং সামাজিক মালিকানার পক্ষে যারা লড়ছে তাদের কসম-খাওয়া দুশমন। পুঁজিবাদকে রক্ষা করার কাজটা চাচা লাদেন করেছেন প্রচ্ছন্ন ভাবে, ভাতিজী করতে চাইছেন সরাসরি; পার্থক্য অতটুকুই।
মধ্যপ্রাচ্যে মহাজাতীয়তাবাদী ট্রাম্পের কূটনৈতিক বিজয় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মহাজাতীয়তাবাদী নেতানেয়াহুর সন্তোষটা তুলনামূলক ভাবে অধিক হওয়ারই কথা। সেটা কেবল রাষ্ট্রীয় বিজয়ের কারণে নয়, ব্যক্তিগত কারণেও। সোদরপ্রতিম ট্রাম্পের তুলনায় তিনি যে কিছু কম বিপদে আছেন তা নয়। তার বিরুদ্ধে ঘুষ ও প্রতারণার মস্ত মস্ত অভিযোগ রয়েছে। মামলা হয়েছে। মামলা বিচারাধীন আছে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ দেখা গেছে। এমন একটা দুঃসময়ে কূটনৈতিক এই ‘বিজয়ে’ জাতীয়তাবাদীদের তিনি কাছে টানতে পারবেন বলে ভরসা করছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় নীতি অনড় থাকবে; অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের বাস্তুহারা করার কাজ চলবেই, চলবেই। অবশ্য তিনি এও বলেছেন যে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো সবই ভুয়া। এগুলো সবই বামপন্থীদের উদ্ভাবনা। ভাগ্যিস তার দেশে কিছু বামপন্থী আছেন, নইলে কাকে দুষতেন?
পুঁজিবাদীদের জন্য বামপন্থিদের ছিটেফোঁটা থাকাটা সুবিধাজনক বৈকি। বামপন্থিদের ঘাড় যথেষ্ট প্রশস্ত না হলেও বোঝা চাপানোর জন্য উপযুক্ত বটে; আর বামপন্থিরা আসছে বলে ভয় দেখানোটাও সুবিধাজনক। নইলে শরিকে শরিকে ঝগড়া বৃদ্ধি পাওয়ার ও প্রকাশ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। শোনা গেল নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পের মতোই নেতানেয়াহুও মনোনীত হয়েছিলেন। ভালো কথা। খুবই ভালো হতো ট্রাম্প ও নেতানেয়াহু দুজনে মিলে পুরস্কারটা পেলে। দুজনেই তো ফিলিস্তিনিদের গলা চেপে ধরার ব্যাপারে পারঙ্গম। গলা চেপে ধরলে আর আওয়াজ দিতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। কবরের শান্তিই তো সবচেয়ে ভালো শান্তি।
লেখক ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়